ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ২০১০-২০১২, সকল অপরাধের রেকর্ড

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নানা রকম অপকর্ম বিশেষ করে প্রতিপক্ষের উপর হামলা, শিক্ষকদেরকে লাঞ্ছিত, সাংবাদিকদেরকে লাঞ্ছিত করা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ সহ নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনাটি হল আবু বকরের মৃত্যু। ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষের বলি মেধাবী ছাত্র আবু বকর। আবু বকরের জন্য এখনো কাঁদছে তার বাবা মা সহপাঠিরা। অন্যন্য সকল হত্যাকান্ডের মতো আবু বকরের হত্যাকান্ডের বিষয়টি ও আস্তে আস্তে ফাইলের নিছে পড়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনাও ঘটেছে এবছর। শিক্ষক লাঞ্ছনার রেকর্ড করেছে ছাত্রলীগ। যার প্রত্যেকটি ঘটনায় নামেমাত্র তদন্ত কমিটি ঘটন করে গুরুদন্ডে লঘু শাস্তি দেয়া হয়েছে। এবছর সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম ছিল পহেলা বৈশাখের কনসার্টে মেয়েদেরকে লাঞ্ছিত করা। নিজেরা তো মেয়েদেরকে লাঞ্ছিত করেছেই। এমনকি যারা এটার প্রতিবাদ করতে গিয়েছে তাদেরকে ও মেরেছে তারা। ছাত্রদলকে কোন ক্রমেই তারা ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে প্রবেশ করতে দেয়নি। এমনকি শিবির নাম করে প্রায় ৩০ জন সাধারণ শিক্ষার্থীর মোবাইল ও মানিব্যাগ ও ছিনতাই করেছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গাকে তারা বানিয়েছে নেশার আসর। ইদানিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বাথরুমে ফেনসিডিলের বোতলের কারণে তা পরিস্কার করতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিনা বাধায় তারা চাঁদাবাজি চালিয়েছে। ক্যাম্পাসে সড়ক দুর্ঘটনা আর এর জের ধরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। ছাত্রলীগের
২০১০ সালের আলোচিত ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে তুলে ধরা হল-

শিক্ষক লাঞ্ছনার রেকর্ডঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার রেকর্ড করেছে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। গতবছরেই তার প্রায় ১২ জন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেছে। প্রত্যেক লাঞ্ছনার ঘটনা পেছনে একটিই কারণ তাদের মনমত কাজ না হওয়া। সর্বশেষ গত ১০ আগষ্ট খেলার মাঠে ছাত্রলীগ লাঞ্ছিত করেছে ৫ শিক্ষককে। এছাড়া এফ রহমান হলে পহেলা বৈশাখের খাবার ছাত্রলীগ ক্যাডারের মন মত না হওয়ার তারা কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে।

ছাত্রদলের ৮১ জন আহতঃ জানুয়ারী থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের প্রায় ৮১ জন কর্মীকে আহত করে। বিশেষ করে ১৮ জানুয়ারী ছাত্রদল সভাপতি টুকু ও তার সমর্থকদের উপর হামলা অন্যতম। এসময় টুকু মারাত্মকভাবে আহত হন। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম খান ও শাহবাগ থানার ওসি রেজাউল করিমসহ আরও অনেকে আহত হন। এ হামলায় ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রকাশ্যে পিস্তল, কিরিচ, রামদা, হকিস্টিক, বোমা, ককটেল ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা ভিসির সঙ্গে দেখা করার জন্য পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ক্যাম্পাসে গেলে ছাত্রলীগ কর্মীরা টুকুর ওপর এ হামলা চালায়। হামলা তীব্রতর হলে টুকুসহ ছাত্রদল নেতাদের বাঁচাতে লাঠিচার্জ ও কমপক্ষে ৩০টি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।

বাংলা বর্ষবরণে অর্ধশত তরুণী লাঞ্ছিতঃ বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীকে লাঞ্ছিত করেছে। এসময় তারা অনেক তরুণীর পায়জামা পর্যন্ত খুলে ফেলেছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সেদিন সন্ধায় টিএসসির কনসার্টের আশপাশ এলাকায় সম্ভ্রম রক্ষায় তরুণীদের চিৎকার ও ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। এক তরুণীকে বিবস্ত্রও করে ফেলা হয়।। দুষ্কৃতিকারীরা চার যুবতীর কামিজ ছিঁড়ে ফেলে, ওড়না টেনে নিয়ে যায় এবং ঝাপটে ধরে। টিএসসির সামনের গেটে নির্যাতনের শিকার হন পাঁচ ছাত্রী। ছাত্রী নির্যাতনকারীরা অধিকাংশই জিয়াউর রহমান হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ছাত্রলীগ কর্মী।

ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে আহত ৬৯ঃ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অথবা তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ছাত্রলীগ প্রতি মাসই সংঘর্ষ বাঁধিয়েছে। এত করে প্রায় ৬৯ জন আহত হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের মধ্যে চেইন অব কমান্ড না থাকায় তারা এ সংঘর্ষ গুলো ঘটিয়েছে বলে অনেক ছাত্রলীগ কর্মী জানায়।

ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল এ বছরের প্রথম মাসে। ২১ জানুয়ারি গভীর রাতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে অনার্স প্রথমবর্ষ ভর্তি পরীক্ষার তিনটি সেটের সবগুলোই ফাঁস করে। ওই রাতেই কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। গোপন তথ্যে মাধ্যমে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার নেপথ্যে ছিল ছাত্রলীগ। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পুলিশ মূল হোতাদের আটক করতে না পারলেও তাদের সহযোগী ছাত্রলীগ কর্মী টিটু (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ) ও সুমন ওরফে নলা সুমন (ম্যানেজমেন্ট ৪র্থ বষ)-কে আটক করে।

ছাত্রলীগের কোন্দলের বলি মেধাবী প্রাণঃ ২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় মারা যান ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হতে হয় এই নিরীহ মেধাবী ছাত্রকে। সংঘর্ষের সময় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে দু'দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে মারা যান। আবু বকরের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। মিষ্টভাষী ও বিনয়ী আবু বকর কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি সাধারণ ছাত্র হিসেবে হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষে থাকতেন। সারাদিন পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। খরচ মেটাতে করতেন টিউশনি। আবু বকর মারা যাওয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গণমাধ্যমে 'এটা কোনো ব্যাপার না, এমনটি ঘটতেই পারে। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে মন্তব্য করেন। এ মন্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিতে ক্যাম্পাসে আবারো বিক্ষোভের ঝড় উঠে। সিন্ডিকেট এই খুনের শাস্তি হিসেবে সাময়িক বহিষ্কারের ব্যবস্থা নেয় মাত্র। গুরু দণ্ডে লঘু শাস্তিতে প্রকারান্তরে পুরস্কৃত হয় ছাত্রলীগ।

ছাত্রীনেত্রীদের চুলাচুলি
ঢাবি ক্যাম্পাসে কেবলমাত্র ছেলারাই নয়। মেয়েরাও একাধিক বার সংঘর্ষ বাঁধিয়েছে। ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৬৪তম জন্মদিন পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের মহিলা কর্মীরা প্রকাশ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। নেতাকর্মীদের সামনে হামলা, ব্যাপক ধস্তাধস্তি, চুলাচুলিতে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইডেন কলেজ শাখার মেয়েরা। এ হামলা ও সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ব্যাপক নির্যাতন
পূর্বশত্রু তার জের ধরে প্রায় ৩০ জন সাধারণ শিক্ষার্থীর সর্বস্ব লুটে নিয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দাবি করে এরা সবাই শিবির। এমনকি মুখে দাড়ি রাখার কারণে শিবির বলে তারা একাধিক নিরিহ ছাত্রকে ব্যাপক মারধর করে। তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে তাদেরকে ব্যাপক হয়রানি করে। এমনকি ছাত্রলীর ক্যাডারদের কথা না শুনায় এফ এইচ হল, একুশে হল, এসএম হল থেকে তারা বিভিন্ন সময়ে প্রায় শতাধিত শিক্ষার্থীকে গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেয়।

অনিয়ন্ত্রিত চাঁদাবাজি
ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অনিয়ন্ত্রিত চাঁদাবাজির কারণে ঢাবির বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন মালিকদের পালানোর অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে মহসিন হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল অন্যতম। ব্যাপক ফাও খাওয়া ক্যান্টিন মালিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চাঁদা নেয়ায় তারা হল থেকে পালিয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও ছাত্রলীগের সিট বাণিজ্য অবৈধ ভর্তি টেন্ডার বাজি অব্যাহত রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি হলের শিক্ষার্থীর এখনো ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি। ক্ষমতাশীল দলের অংগসংগঠন হওয়াতে প্রশাসন ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নিতে এখনো ব্যর্থ হচ্ছে।

সাংবাদিক নির্যাতনে অতিতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ
২০১০ সালে সাংবাদিকদেরকে নির্যাতনের এক মহাউৎসব চালিয়েছে ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে সাংবাদিকদেকে লাঞ্ছিত নির্যাতন করে অতীতের সকল রেকর্ড তারা ভঙ্গ করেছে। যে কোন অপরাধ করলে যেহেতু তাদের শাস্তি হচ্ছে না। তাই তারা বীর দর্পে কারণে অকারণে এমনকি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। প্রায় পনের জন সাংবাদিককে তারা বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছিত এমনকি শারীরিক নির্যাতন করেছে। সাংবাদিকদের শারীরিক নির্যাতন করার কারণে যদিও তাদের কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যলয় থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে। কিন্তু তারা সবাই এখনো ক্লাস করছে এমনকি হলেও থাকছে। কে থামাবে এদের? কার এত বুকের পাটা?
  • 0Blogger Comment
  • Facebook Comment